• রোববার ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

  • || ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

মেঘ নেই আমার সকালে

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

বাবার আদর কেমন তা কখনো জানার ভাগ্য হয়নি, জন্মের আগে বাবা আমাকে রেখে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। যখন স্কুলে পড়ি মা তখন প্রায়ই বাবার কথা বলতেন। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সময় মাও আমাকে ছেড়ে চলে যান দূর আকাশে। এই ছোট্ট জীবন তখনই একা হয়ে গিয়েছিল।

কষ্ট নিয়ে আমার বেড়ে ওঠা। মনের ঘরে নিজেকে অনেকবার প্রশ্ন করেছি– জীবন পথে কীভাবে চলবো পৃথিবীর আকাশের নিচে? দেখতে দেখতে এইচএসসি পাস করলাম গ্রাম থেকে। আমার ছোট গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকা শহরে চলে এলাম। মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিংয়ে ভর্তি হলাম। আমার পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য গ্রামের বাড়িতে আমার নামের কিছু জমি বিক্রি করা হলো। ছোট জীবনে ভালো মতো বাঁচার জন্য লড়াই করে যাচ্ছিলাম।

একদিন কোচিং শেষে বাসায় ফিরছি, হঠাৎ দেখি মানুষের ভিড়। আমিও গেলাম কী হলো দেখতে। দেখি একজন বয়স্ক নারী রাস্তায় পড়ে আছেন। কেউ কোনো সহযোগিতা করছে না। আমি তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। তার জ্ঞান ফিরলে বাসার লোকদের খবর দেওয়া হলো, ওইদিন প্রথম আমার মেঘের সঙ্গে দেখা। যদিও জানতামই না এই মানুষটিই আমার জীবন চলার পথের শক্তি হবে। যে আন্টিকে আমি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম তার ছেলের নাম মেঘ।

সেদিন সে আমাকে দেখে মিষ্টি করে হেসেছিল। নিজের অজান্তে তার হাসি মনে জায়গা করে নিলো। হাসপাতাল থেকে বিদায় নেওয়ার সময় মেঘকে আমার মোবাইল নম্বর দিয়ে এসেছিলাম, তার মায়ের শরীর ভালো হলে যেন আমাকে জানায়।

কিছুদিন পর আমি বরিশাল মেডিকেলে চান্স পেলাম। যেদিন ঢাকা থেকে বরিশাল চলে যাবো সেদিন মেঘ কল দিয়ে জানালো তার মা মারা গেছেন। শুনে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। কী করবো চিন্তা করে পাচ্ছিলাম না। পরে সিদ্ধান্ত নিয়ে মেঘদের বাড়িতে যাই।

দুদিন পর বরিশাল চলে আসি। ক্লাস শুরু হয়। তবে মেঘের জন্য কেন জানি খুব খারাপ লাগতে শুরু করে! মেঘ প্রায়ই ফোন দেয়। আমি যে তাকে পছন্দ করি তা কখনো বলতাম না।

একদিন সকালে ক্লাসে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি মেঘ আমার কলেজ গেইটে দাঁড়ানো। কিছু বোঝার আগে নিজের অজান্তে চোখে জল চলে এলো। মেঘ আমাকে খাওয়ানোর প্রস্তাব দিল। সাথে সাথে আমি রাজি হয়ে গেলাম। বিকেল বেলা দু'জনে হাঁটতে হাঁটতে কলেজের দিকে যাচ্ছিলাম, কারণ বিকেলে আমার ওয়ার্ড ক্লাস ছিল। মেঘ গোধূলি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, 'মায়া, আমি তোমাকে ভালোবাসি।' এই কথা শোনার পর আমি কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না, আমার হাতটি শক্ত করে ধরে মেঘ বললো, 'থাকবে তো আমার পাশে।'

আমি সেদিন মেঘকে না করতে পারিনি। আমিও মেঘকে বলে দিই– 'যেদিন তোমাকে প্রথম হাসপাতালে দেখেছিলাম তখনি তোমাকে খুব পছন্দ করেছিলাম, কখনো বলা হয়ে ওঠেনি। মেঘ, পৃথিবীতে আমার কেউ নেই আপন বলতে, তুমি আমার ঘরের স্বপ্ন হয়ে পাশে থাকবে তো?'

মেঘ ঢাকা চলে যায়। প্রতিদিন কথা হয় ফোনে। মেঘ ব্যবসার কাজে নিয়মিত দেশের বাইরে যাতায়াত করে। যতদিন দেশের বাইরে থাকে ততদিন আমি রোজা রাখি। ওর জন্য জীবন দিতেও আমার কষ্ট হবে না, মেঘ যে আমার বেঁচে থাকার আলো।

একদিন হঠাৎ মেঘ আমার ফোন ধরে না। সারাদিন কল দিয়েও সাড়া পেলাম না। পরের দিন আমি ঢাকায় গিয়ে মেঘের অফিসে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে আমাকে জানায়, তাদের সাহেবের গায়ে হলুদ। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! এটি হতে পারে না আমার সাথে। তখন নিজেকে আবার বড় অসহায় মনে হচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পর মোবাইলে একটি মেসেজ আসে– আমি যেন মেঘের সঙ্গে আর যোগাযোগ না করি! সে আমার সঙ্গে যা করেছে তা যেন ভুলে যাই! তখন মনে হচ্ছিলো আমার দেহের প্রাণটা চলে গেছে। যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম, সে আজ আমার জীবনে আর নেই।

কিছুদিন পর এমবিবিএস পাশ করলাম। মানুষটি সবসময় বলতো– তুমি ডাক্তার হলে প্রথম সকালটা আমার জন্য রাখবে। আজ আমি ডাক্তার, তবে মেঘ নেই আমার সকালে।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ