• শনিবার ১৮ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

  • || ০৯ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

সিজারে উৎসাহী প্রাইভেট ক্লিনিক

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৭ জুলাই ২০১৯  

মুক্তা বেগম। সিজার করিয়ে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখেছে তার প্রথম সন্তান। তার মত আরো একজন ঝর্ণা হালদারও করিয়েছেন সিজার। ঝর্ণা বা মুক্তার মতো, গোপালগঞ্জের বেশিরভাগ প্রসূতি মায়েরা ঝুঁকছেন সিজারিয়ান অপারেশনে। সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য মতে গত চার বছরে শুধুমাত্র গোপালগঞ্জের সরকারি হাসপাতালে সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করিয়েছেন ৩ হাজারের বেশী প্রসূতি মা। যার মধ্যে ২০১৬ সালে হয়েছে সবচেয়ে বেশি ৯৭২ জন।

সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, গোপালগঞ্জের ৫ উপজেলার সরকারি হাসপাতালে ২০১৫ সালে স্বাভাবিক বাচ্চা প্রসব হয়েছে ২ হাজার ৪২৬টি, আর সিজার করে বাচ্চা প্রসব হয়েছে ৭১৬টি। ২০১৬ সালে স্বাভাবিক বাচ্চা প্রসব হয়েছে ২ হাজার ২৮টি, আর সিজারের মাধ্যমে ৯৭২টি এবং ২০১৭ সালে স্বাভাবিক বাচ্চা প্রসব হয়েছে ২ হাজার ২৩৮টি এবং সিজারের মাধ্যমে ৭৫৬টি। আর ২০১৮ সালে স্বাভাবিক বাচ্চা প্রসব হয়েছে ২ হাজার ৫২৪টি এবং সিজারিয়ান অপারেশন হয়েছে ৭৮৪টি।

সরকারি হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশন তুলনামূলক কম হলেও ব্যতিক্রম ক্লিনিকগুলো। গোপালগঞ্জে একশোর বেশি বৈধ-অবৈধ ক্লিনিক রয়েছে। এসব ক্লিনিকে শতকরা ৯০ ভাগই সিজার হয়। তবে সঠিক পরিসংখ্যান নেই কারো কাছেই। দিন দিন সিজারের সংখ্যা বাড়ার পেছনে বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে অসাধু চক্রের দৌরাত্মকে।
 
পরিসংখ্যান বলছে, গোপালগঞ্জে আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার। এই হার বাড়ার পেছনে মায়ের শারীরিক জটিলতা ছাড়াও রয়েছে কিছু অসাধু চক্রের দৌরাত্ম্য। চিকিৎসকরা বলছেন, সিজারের ফলে মা ও শিশু ভবিষ্যতে নানা জটিলতার সম্মুখিন হতে পারে। তাদের মত, সিজার এড়ানো সম্ভব হলে ভবিষ্যতের অনেক জটিলতা থেকেই বেঁচে যেতে পারে মা ও শিশু। এদিকে, সিজার বাড়ার পেছনে শারীরিক জটিলতা ছাড়াও মায়েদের আগ্রহকেই বড় কারণ হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ।

গত কয়েকদিন জেলার কয়েকটি হাসপাতাল ও ক্লিনিক ঘুরে দেখা গেছে, প্রসূতি মায়েদের হাসপাতাল বা ক্লিনিকে আনলেই সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে। এসব হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে স্বাভাবিক বাচ্চা প্রসবের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার। সরকারি হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসব করানো হলেও ক্লিনিকে কারণে-অকারণে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার করা হয়। হাসপাতালগুলোর হিসাব পাওয়া গেলেও ক্লিনিকগুলোর হিসাবে রয়েছে গরমিল। তারা তথ্য নথিভুক্ত করে না। সিভিল সার্জন অফিসে প্রতিটি ক্লিনিকের প্রতি মাসে প্রতিবেদন করার কথা থাকলেও তা মানা হয় না। নজরদারি না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে সিভিল সার্জন অফিসের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন।

তবে, গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. তরুণ কুমার মন্ডল বলেন, লোকবলের অভাবে ক্লিনিকগুলোতে মনিটরিং করা সম্ভব হয় না। তাদের প্রতি মাসে কার্যক্রমের বিবরণ আমাদের অফিসে লিখিত আকারে জানানোর কথা। বলতে গেলে কেউই তা ঠিকমত করে না। লোকবল সংকটের কারণে আমরাও পেরে উঠি না। এ কারণে ক্লিনিকগুলো ব্যবসার আড়ালে কোনো রোগীর অস্ত্রোপচারের দরকার না হলেও টাকার লোভে সিজারিয়ানে বাচ্চা প্রসব করায়। তবে, কিছু কিছু ক্লিনিকের নরমাল ডেলিভারীতে রোগীদের উৎসাহিত করা হয়। এখানে মূলত, ক্লিনিক মালিকদের পাশাপাশি ডাক্তারদেরও আন্তরিকতা থাকা জরুরী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রসূতী নারীর স্বজন জানান, হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসকের পরামর্শে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে। চিকিৎসকরা বাচ্চার অবস্থান ঠিক নেই, মাথা ওপরের দিকে, গলায় নারী পেঁচিয়েছে এ ধরনের বিভিন্ন সমস্যার কথা বলেন। এ ছাড়া অপারেশন লাগবে, তা না হলে বাচ্চা বা মায়ের জীবন নিয়ে সংশয় এ ধরনের কথা বলে। এর ফলে বাধ্য হয়ে রোগীর স্বজনরা অস্ত্রোপচারে রাজি হন। রোগীদের সমস্যায় ফেলে অস্ত্রোপচারে বাধ্য করা হয়। এর প্রতিকার হওয়া উচিত।

সদর উপজেলার সাতপাড় গ্রামের বিউটি বিশ্বাস বলেন, আমার পুত্রবধূকে নিয়ে গোপালগঞ্জ লাবিবা ক্লিনিকে এসেছি। ডাক্তার কোনো পরীক্ষা না করে বলেন এখনই সিজার করতে হবে। তা না হলে সমস্যা হবে। বিপদের কথা চিন্তা করে আমরা অপারেশন করাতে বাধ্য হই।

টুঙ্গিপাড়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামের ঝর্ণা হালদার বলেন, আমার প্রথম বাচ্চা স্বাভাবিকভাবেই জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বাচ্চার জন্মের সময় প্রসব বেদনা একটু বেশি সময় থাকায় বাড়ির লোকজন আমাকে শহরের একটি ক্লিনিকে নিয়ে আসে। সেখানে ডাক্তার আমার স্বামীকে বলেন, আর দেরি করা যাবে না। অপারেশন করতে হবে। তা না হলে সমস্যা হতে পারে। এ কারণে সিজার করেছি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চিকিৎসক জানান, ঝর্ণা হালদারের মতো এমন হাজার প্রমাণ মিলবে বিভিন্ন ক্লিনিকে। এখন রোগী বা চিকিৎসক কেউই সমস্যায় পড়তে চায় না। সিজার করতে লাগে মাত্র ৩৫-৪০ মিনিট। এতে বাচ্চা ও মা থাকে নিরাপদ। অনেকে ইচ্ছা করে সিজার করে থাকে। এতে স্বাভাবিক জন্মপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে তিনি স্বীকার করেন।

শহরের একটি ক্লিনিকে কথা হয় টুঙ্গিপাড়া উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের আলমগীর শেখের স্ত্রীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার প্রথম বাচ্চা সিজার করে হয়েছে। তাই দ্বিতীয়জনের জন্য সিজার লাগবে। বাধ্য হয়ে অপারেশনে মত দিই।

গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. অসিত কুমার মল্লিক, গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের গাইনি কনসালটেন্ট ডা. ফারিয়া জামান ও গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী জানান, হাসপাতালগুলোতে একান্ত প্রয়োজন না হলে কখনো সিজার করে বাচ্চা প্রসব করানো হয় না। তবে ক্লিনিকগুলোর চিত্র ভিন্ন। সেখানে স্বাভাবিক বাচ্চা প্রসবের ঘটনা খুবই কম। ক্লিনিকের মালিকদের অতিরিক্ত টাকার লোভ, আর তাদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কিছু চিকিৎসকও।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন গোপালগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি ডা. আবিদ হাসান বলেন, শুধু চিকিৎসকরা দায়ী নন। এর জন্য রোগী বা তার অভিভাবকরাও দায়ী। কিছু কিছু রোগীর অবস্থা খারাপ থাকে আবার কিছু রোগীর অবস্থা ভালো থাকে। এটা নির্ভর করে রোগীর অবস্থার ওপর। তবে বেশির ভাগ ক্লিনিকে সিজারিয়ানে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এটা বন্ধ হওয়া উচিত।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ