• শনিবার ১৮ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

  • || ০৯ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

বয়ঃসন্ধিকালে যৌন হয়রানি শিকার ৬০ শতাংশ, বাড়ছে বাল্যবিবাহ

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯  

বয়ঃসন্ধিকালে প্রায় ৬০ ভাগ মেয়েশিশু পাবলিক পরিসরে যৌন হয়রানির শিকার হয়।জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বেরিয়ে আসা এই তথ্যকে ভয়াবহ বলে উল্লেখ করে গবেষকরা বলছেন, পর্যবেক্ষণ বলছে— এতে করে বাল্যবিবাহের হার কমানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা বলছেন, জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় শতভাগ নারী মনে করেন, পাবলিক প্লেস ও অফিস আদালতে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির বিচারে পৃথক বিশেষায়িত আইন দরকার।

বয়ঃসন্ধিকালে অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন সংস্পর্শের কারণে পরবর্তী যৌন জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় উল্লেখ করে মানসিক চিকিৎসকরা বলছেন, যে ট্রমার মধ্য দিয়ে তারা বড় হয়, সেখানে আচরণে স্বাভাবিকত্ব লোপ পাওয়ার শঙ্কা থাকে।

১২ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৩৯২ জন নারীর মতামতের ভিত্তিতে সম্প্রতি করা এক জরিপে দেখানো হয়েছে ৫৯.৪৫ শতাংশ নারী ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যেই পাবলিক প্লেসে জীবনে প্রথমবারের মতো যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। ৫.৪৭ শতাংশ নারী ৬ বছর বয়সের আগেই এবং ১৫.২৬ শতাংশ নারী ১০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে জীবনে প্রথম যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।

পাবলিক প্লেসে যৌন হয়রানির প্রবণতা যে বেড়ে গেছে, সেটা গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে উল্লেখ করে গবেষণার সঙ্গে জড়িত জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি , ‘বাজার, ডাক্তারের চেম্বার, ধর্মীয় উপাসনালয় যেখানেই যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো ইঙ্গিতের মাধ্যমে ঘটেছে এমন নয়, শারীরিক স্পর্শের মধ্য দিয়েও গেছে।’

হয়রানির শিকার হলে সেখানে উপস্থিত অন্য পুরুষদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল প্রশ্নে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন, ৬৪.৫৪ শতাংশ পুরুষ নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল এবং ১১ শতাংশ নির্যাতনকারীর পক্ষে কথা বলেছে। তিনি বলেন, ‘নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আমরা সমন্বিত আইন চাই। আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, এই সময়টাতে যৌন হয়রানির ঘটনা ঠেকাতে না পারার কারণে বাল্যবিবাহ কমানো যাচ্ছে না। ২০০৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশনামূলক নীতিমালায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মস্থলে যৌন হয়রানী প্রতিরোধ ও প্রতিকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হলেও এর পরিধি আরও ব্যাপক বলে আমরা মনে করি।’

এটি শুধু শারীরিক নির্যাতন না মানসিক নির্যাতন হিসেবে উল্লেখ করে নাছিমা আক্তার জলি  বলেন, ‘নারীর চলাচল যদি সহজ না হয়, তাহলে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে কী করে। নারীর বাইরের জগত যদি নিরবচ্ছিন্ন করা না যায়, তাহলে আমরা আর্থিকভাবে ও জাতিগতভাবে পিছিয়ে যাবো। এখনও যৌন হয়রানির বিষয়ে কথা বলার বিষয়ে নানা ট্যাবু কাজ করে সেটিও নারীকে সামনে এগুতে বাধাগ্রস্ত করে।’

ট্যাবুর কারণে যৌন শিক্ষা বিষয়ে কথা না বলায় বয়ঃসন্ধিকালে যৌন হয়রানি বেশি হতে হচ্ছে কিনা প্রশ্নে সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স ও চাইল্ড প্রোটেকশন সেক্টরের পরিচালক আবদুল্লা আল মামুন বলেন, ‘একটা মেয়ে শিশু এ সমাজে বড় হয়ে ওঠার সময় তার চারপাশে তার চেয়ে অগ্রজ নারীদের যেভাবে দেখেছে, সেটাকেই সে স্বাভাবিক ভেবে নেয়। তাকে আমরা কেউ ছোটবেলা থেকে শেখাই না যে, কোন আচরণগুলো অগ্রহণযোগ্য, কোনগুলো নির্যাতন এবং কোন ধরনের নির্যাতনে তার কী করণীয়।’

তিনি আরও বলেন,‘এক্ষেত্রে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে ছেলে ও মেয়ে শিশুদের শেখাতে হবে কোন আচরণগুলো করা যাবে না, কোন আচরণগুলো নির্যাতন। এমনকি মেয়ে শিশুদের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষামূলক বিভিন্ন দক্ষতা ও প্রতিকারের পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই আত্মরক্ষার কৌশল যেন কোনও অবস্থাতেই অন্যের দ্বারা ঘটানো কোনও নির্যাতনকে মেনে নিয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখার কৌশল না হয়, বরং ছেলেমেয়ের সমান মর্যাদা ও অধিকারের বিষয়টি মাথায় রেখে মেয়ে শিশুদের ক্ষমতায়িত করতে হবে। পক্ষান্তরে ছেলে শিশুদের মাঝে তার প্রতিটি আচরণের জন্য দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিতার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। নির্যাতন নির্যাতনই, কেউই তা করে পার পাবে না— এই নীতি বাস্তবায়নে পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে  এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম মনে করেন, বয়ঃসন্ধিকালে যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তিনি  বলেন, ‘জনসম্মুখে যৌন হয়রানি করা কোনও স্বাভাবিক আচরণ নয়। উন্মুক্ত জায়গায় নারীকে যৌন হয়রানি করা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও যৌনবিকৃতির উদাহরণ। এই চিকিৎসক মনে করেন, বিকাশের যে কয়েকটি স্তর আছে তারমধ্যে ১১ থেকে ১৭ বছর বয়স সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এই সময় বিভিন্ন দিক থেকে একজন পরিণত হতে শুরু করে এবং দ্রুত বিকাশ ঘটে।

তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এই সময় হরমোনজনিত নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে শিশুকে পরিবেশ ও প্রতিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার বিষয়টি শিখতে হয়। সেসময় যদি সে এধরনের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়, তাহলে বাকি জীবনে সে আর ইতিবাচকভাবে ভাবতে শিখবে না।’

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ