• বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

  • || ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

জনবান্ধব ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৫ অক্টোবর ২০১৯  

আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আনিসুল হক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর প্রয়াত সিরাজুল হক ছিলেন বরেণ্য রাজনীতিক ও প্রখ্যাত আইনজীবী। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন সিরাজুল হক। আইনজীবী হিসেবে আনিসুল হক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন। এছাড়া বিডিআর হত্যা মামলাসহ বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ মামলা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী হিসেবে তার ভ‚মিকা ছিল উল্লেখ করার মতো। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা-আখাউড়া আসন থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হন আনিসুল হক। এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠন হলে সেই সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। এরপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসন থেকে ফের নির্বাচিত হয়ে দ্বিতীবারের মতো আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আনিসুল হক।  সম্প্রতি তার সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হল।

ঢাকায় ৫০টির বেশি ক্যাসিনোসহ দেশের অনেক জায়গায় ক্যাসিনো ব্যবসার সন্ধান পাওয়া গেছে। আবার এসব ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে যুক্তদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকেই এই ব্যবসার মাধ্যমে আয়কৃত টাকা বিদেশে পাচার করছেন। কিন্তু ক্যাসিনোর জন্য দেশে শক্তিশালী আইন নেই। এ ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ কী?

আনিসুল হক : ১৮৬৭ সালের জুয়া আইন দিয়ে ২০১৯ সালের ক্যাসিনো অপরাধের বিচার করা সম্ভব নয়। যারা জুয়া খেলছে তারা ক্রিমিনাল মোটিভের ভেতর ঢুকে গেছে। তাদের আইনের আওতায় আনতে হলে ১৫০ বছরের পুরনো আইন দিয়ে কাজ হবে না। আর জুয়া খেলা বন্ধও করা যাবে না। তাই অবশ্যই নতুন কিছু করার চিন্তা করতে হবে। প্রয়োজন হলে পুরনো আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। পাশাপাশি প্রচলিত অন্য আইনগুলোর সহায়তা নিয়ে এসব জুয়াড়ি ও জুয়া-সংশ্লিষ্টকে বিচারের আওতায় আনা যেতে পারে।

খেয়াল করলে দেখবেন , বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে গণিকাবৃত্তি ও জুয়া  খেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্রকে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া ১৮৬৭ সালের প্রকাশ্য জুয়া আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় (বাংলাদেশের মধ্যে) যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো ঘর, তাঁবু, কক্ষ, প্রাঙ্গণের মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী বা ব্যবহারকারী হিসেবে অনুরূপ স্থানকে সাধারণ জুয়ার স্থান হিসেবে ব্যবহার করতে দিলে এবং যে কেউ এসব স্থানকে ব্যবহারের দায়িত্বে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন অথবা যে কোনো সাহায্য করলে এবং ওইসব স্থানে যে কেউ জুয়া খেলার উদ্দেশে অর্থ দিলে সে অভিযুক্ত হিসেবে অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা এবং অনূর্ধ্ব তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা উভয়দ্ণডে হবে।

ক্যাসিনো বন্ধ ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হলেও এসবের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের প্রচলিত জুয়া আইনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ দেশে ক্যাসিনো চালালে কী ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে, সে বিষয়ে কোনো আইন  নেই। মানি লন্ডারিংসহ অন্য অপরাধ গণ্য না করা হলে এবং নতুন আইন করা না হলে ‘ক্যাসিনো কাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে ১৮৬৭ সালের ‘প্রকাশ্যে জুয়া আইনে’ মামলা হতে পারে। আইনটির সংশোধন নিয়ে কাজ চলছে।

উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও গত ৪১ বছরে কোনো আইন প্রণয়ন হয়নি। বলা হচ্ছে এখনো রাজনৈতিক বিবেচনাতেই বিচারক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ কী?

আনিসুল হক : সংবিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতি পরামর্শক্রমে বিচারক নিয়োগ দেবেন। এখানে আইন মন্ত্রণালয়ের কিছুই করার নেই। অত্যন্ত স্বচ্ছতার মধ্যেই বিচারক নিয়োগ হচ্ছে। তারপরও আইন বা নীতিমালা করা যায় কি না, এ নিয়ে মন্ত্রণালয় চিন্তাভাবনা করছে। ১৯৭৮ সালে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১২ সালে প্রথম আইন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। কাজ চলছে। এরপর আইনটির খসড়া চড়ান্ত করা হবে। তাছাড়া কোনোভাবেই রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে অনেক নতুন আইন করা হচ্ছে। জনবান্ধব আইন ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

এই শুদ্ধি অভিযানে আপনাদের দলের লোকজন বেশি ধরা পড়ছেন। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মনে করছেন বিরোধীরা। আপনার অভিমত কী?

আনিসুল হক : এই অভিযানে শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও সরকারের ভাবমূর্তি বাড়ছে। কারণ কোনো দেশেই সাধারণ ক্ষমতাসীনরা নিজেদের দলের বিচার করে না। বাংলাদেশেও বিগত সরকারগুলো তা করেনি। এটাও সরকারের একটি দৃষ্টান্তমূলক কাজ। এটা কেবল শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব। বিএনপি ও বা অন্য যারা বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করছে, তা ঠিক নয়। নিজের দল থেকেই শুদ্ধি অভিযান হওয়া দরকার।

বিরোধী পক্ষ সাম্প্রদায়িক উসকানিসহ নানা ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে ভোলার বোরহান উদ্দিনের ঘটনাও এর বাইরে নয়। আমরা শক্ত হাতে এর অনুসন্ধান করছি। আমরা কেউ চাইনি রামুর ঘটনা ঘটুক। আমরা কেউই চাইনি নাসিরনগরের ঘটনা ঘটুক। তবে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে। এ ব্যাপারে আমরা আইনের পরিবর্তন আনব।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের যে মূল চেতনা, আমরা সেই চেতনায় ফিরে যেতে চাই। একইসঙ্গে আমাদের সংবিধানে বলা আছে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের কথা; আমরা এগুলো সুনিশ্চিত করতে চাই। সংবিধানের এই চার নীতি আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পারব না, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে পারব না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে অনেক সোচ্চার এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু যখন সম্পত্তি ভাগাভাগির সময়ে বাবার সম্পত্তি থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করা হয়, এ বিষয়ে যখন কথা ওঠে, তখন আমাদের মাথা নিচু হয়ে যায়। সে ব্যাপারেও সবার মতামত নিয়ে কাজ করছি।

দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত মামলার সাক্ষী পাওয়া যায় না? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা সাক্ষীদের হুমকি ধমকি দেখিয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে কী উদ্যোগ নেবেন আপনারা?

আনিসুল হক :  সাক্ষ্য আইন নিয়ে আমরা কাজ করছি। সাক্ষ্য আইনের আমূল পরিবর্তন না হোক, কিছু পরিবর্তন করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে সাক্ষ্য আইন পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রথম ড্রাফটের আলোচনা শেষ হয়েছে। আমার আশা ডিসেম্বরের সংসদ অধিবেশনে পূর্ণাঙ্গ আইনের খসড়া সংসদে উপস্থাপন করতে পারব। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন আইন সংশোধন করার বিষয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি

বছরের পর বছর গুরুত্বপূর্ণ অনেক মামলার রায়ের আপিল শুনানি হয় না। ১৫ বছর হয়েছে মামলার রায় হয়েছে। আপিল হয়েছে কিন্তু শুনানি শেষ হচ্ছে না। এর সমাধান কীভাবে করবেন?

আনিসুল হক : আমাদের কাছে এসব তথ্যই রয়েছে। বর্তমানে দেশের উচ্চ ও নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫০টি। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অভ‚তপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছে। বর্তমান সরকার মামলাজট কমানোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত অধস্তন আদালতে ৫৭১ জন সহকারী জজ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা পদায়ন করা হয়েছে। এছাড়া ১২তম জুডিশিয়াল সার্ভিস নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে সহকারী জজ নিয়োগের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলাজট কমিয়ে আনা সম্ভব। এ লক্ষ্যে আইনও সংশোধন করা হয়েছে।

বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও পলাতক তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনা কি সম্ভব? 

আনিসুল হক : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানসহ সব দণ্ডিত আসামির সাজা নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে। পাশাপাশি ১৫ আগস্টের ঘটনায় নেপথ্যের ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিশন গঠনের পরিকল্পনা করছে সরকার। আমরা সকল দÐপ্রাপ্ত আসামিকে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি। আমরা নিশ্চয়ই তারেক রহমানকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও মানিলন্ডারিং মামলার রায় কার্যকর করার জন্য তাকে আমরা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, চালিয়ে যাব।

দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণ বাড়ছে এবং উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। মানবাধিকার প্রতিনিধিরা বলছেন, আইনের দুর্বলতার কারণেই পার পেয়ে যাচ্ছে ধর্ষণের আসামিরা। এ কারণেই ধর্ষণ বাড়ছে বলে তারা মত দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?

আনিসুল হক : ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনের কিছু কিছু বিষয় পরিবর্তন করা প্রয়োজন। নারী অধিকার এবং মানবাধিকার কর্মীরা যদি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের মাধ্যমে আইনে পরিবর্তনের কথা বলেন তাহলে সে ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে। আলোচনার মাধ্যমে দেখা যাবে এটা অবমাননাকর বা এটা থাকা উচিত না, এসব না রাখলেও একটা ধর্ষণের মামলা প্রমাণ করা যায়, তাহলে সেগুলো করতে আমাদের কোনো বাধা নেই। তাছাড়া ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ডের অনেকগুলো কেস দ্রত বিচার ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হচ্ছে।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ