• শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩১

  • || ০৮ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

৬৮ কোটি টাকার রাডার কাজে আসছে না

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৪ জুলাই ২০১৯  

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই বিশ্বে দুর্যোগ ঝুঁকির তালিকায় পঞ্চম স্থানে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির শঙ্কায়ও রয়েছে বাংলাদেশ। বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড় আমাদের নিত্যসঙ্গী। এর মধ্যে কয়েক বছর ধরে আরেকটি দুর্যোগ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। এটি হলো বজ্রপাত। বিশ্বে বছরে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যাচ্ছে, তার প্রায় অর্ধেকই ঘটছে বাংলাদেশে। বজ্রপাতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বাংলাদেশে। তাই বিশ্লেষকরা বলছেন, "বজ্রপাতের 'ডেড জোন' এখন বাংলাদেশ।"

সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম সংবাদপত্রের তথ্য পর্যালোচনা করে জানিয়েছে, চলতি বছরে গত দুই মাসে বাংলাদেশে বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন ১২৬ এবং আহত হয়েছেন ৫৩ জন। বর্ষা মৌসুমে প্রায় প্রতিদিনই বজ্রপাতে প্রাণহানি ঘটছে।

শনিবার বজ্রপাতে ১৫ জনের মৃত্যু হয়। পাবনার বেড়ায় বজ্রপাতে দুই ছেলে, বাবাসহ চারজন নিহত হন। সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে বজ্রপাতে বাবা-ছেলের করুণ মৃত্যু হয়। ময়মনসিংহে বজ্রপাতে তিনজন নিহত হন। নেত্রকোনার কলমাকান্দায় একজন নিহত হয়েছেন। আগের দিন শুক্রবার বজ্রপাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জে শিশুসহ দুইজন এবং শেরপুরে এক কৃষক নিহত হন। ২৮ জুন সাতক্ষীরায় বজ্রপাতে একই পরিবারের তিনজনসহ পাঁচজন নিহত হন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা দিতে প্রায় ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালে দেশের আটটি স্থানে লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর স্থাপন করা হয়। বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ এসব রাডার ঢাকা, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা এবং পটুয়াখালীতে স্থাপন করা হয়। কারিগরি দক্ষতার অভাবে রাডারগুলো কোনো কাজে আসছে না।

এ বিষয়ে রাডার বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম বলেন, বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেওয়া এবং রাডার পরিচালনা বা তথ্য সংগ্রহের দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন জনবল আবহাওয়া অধিদপ্তরে নেই। ফলে রাডারগুলো কোনো কাজে আসছে না। যুক্তরাষ্ট্রের রাডার কোম্পানি প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন তাদের এজেন্টদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অযত্নে অবহেলায় রাডারগুলো নষ্ট হচ্ছে। রাডার স্থাপনের আগে বলা হয়েছিল, বজ্রপাতের ১৫ মিনিট আগেই তথ্য জানা যাবে। মোবাইল ফোনে ১৫ মিনিট আগেই ওই এলাকার মানুষকে বজ্রপাতের তথ্য জানিয়ে দেওয়া যাবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক সমকালকে বলেন, রাডারগুলো চালু ও বন্ধ করার দায়িত্ব আমাদের। অনেক সময় নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে চালু হয় না। আর তথ্য  পর্যালোচনার বিষয়টি প্রশাসন বিভাগ বলতে পারবে।

বাংলাদেশে বজ্রপাতের তথ্য রেকর্ড করার প্রযুক্তি নেই। ভারতের আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, বাংলাদেশে গড়ে বছরে তিন হাজার বজ্রপাত হয়। জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে গড়ে বছরে আড়াই হাজার বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বজ্রপাতকে আবহাওয়া সম্পর্কিত দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগাভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। বজ্রপাতে এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে একজন সুস্থ মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ ভৌগোলিক অবস্থান ও বায়ুদূষণ। একদিকে বঙ্গোপসাগর, অন্যদিকে ভারত মহাসাগর। উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি অঞ্চল। রয়েছে হিমালয়। সাগর থেকে আসে গরম বাতাস, আর হিমালয় থেকে আসে ঠাণ্ডা বাতাস। একসঙ্গে দুই রকমের বাতাসের সংমিশ্রণে বজ্রমেঘের আবহ তৈরি হয়। এ রকম একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে বজ্রপাত ঘটে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে প্রতিবছর বজ্রপাতের প্রবণতা আরও বাড়ছে। মানুষ হতাহতের ঘটনাও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। জাপানের জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেমে দেখে গেছে, বজ্রপাতে বেশি মানুষ মারা যায় বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে। বজ্রপাতে নিহতদের মধ্যে কৃষক ও জেলের সংখ্যাই বেশি।

বাংলাদেশের বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ ফারুখ। তিনি বলেন, গ্লোবাল ক্লাইমেট মডেলিং বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বায়ুদূষণ কমানো ও সচেতনতা সৃষ্টি ছাড়া প্রাণহানি কমানো সম্ভব হবে না। বজ্রপাত থেকে বাঁচতে বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে। তিনি আরও বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সারাদেশে এক কোটি তালগাছ লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। এখন পর্যন্ত ৩২ লাখ লাগানো হয়েছে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তালগাছের চারা গরু-ছাগলে খেয়ে ফেলছে। তবে একটি তালগাছ বজ্রনিরোধক ক্ষমতা অর্জন করতে সময় লাগে ২৫ বছর। ফলে এটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। হাওর এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র করা যেতে পারে। বজ্রপাতের সময় মানুষ যাতে আশ্রয় নিতে পারে। বজ্রপাতের সময় বড় গাছের কাণ্ড থেকে ১০ ফুট দূরে থাকতে হবে।

দুর্যোগ ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বজ্রপাতে ২০১৮ সালে ২৯৭, ২০১৭ সালে ৩০৬, ২০১৬ সালে ৩৫১, ২০১৫ সালে ২৭৪, ২০১৪ সালে ২১০, ২০১৩ সালে ২৮৫, ২০১২ সালে ৩০১ এবং ২০১১ সালে ১৭৯, ২০১০ সালে ১১০ জন নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব জিওগ্রাফির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় এক হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বজ্রপাতে। বজ্রপাতে মৃত্যুর চেয়ে দশগুণ বেশি মানুষ আহত হন। এই আহতরা যখন মারা যান তখন আর হিসাবে ধরা হয় না। বজ্রপাতে আহতদের চিকিৎসা বা ওষুধও নেই দেশের হাসপাতালগুলোতে।

যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ২৫ মিলিয়ন বজ্রপাত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় ক্যালিফোর্নিয়ায়। এতে মানুষ মারা যায় মাত্র ২০ থেকে ৩০ জন। ভেনেজুয়েলা ও ব্রাজিলেও রেকর্ড পরিমাণ বজ্রপাত হয়। ভারত, শ্রীলংকা ও নেপালে বজ্রপাতের সংখ্যা বেশি হলেও মৃত্যুর সংখ্যা খুবই কম। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কম বজ্রপাত হলেও মানুষ মারা যাচ্ছে বেশি। বজ্রপাতে বিপুলসংখ্যক গবাদিপশুও মারা যায়। আয়তনে ছোট দেশে বেশি মৃত্যুর জন্য সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন বলেন, বজ্রপাত বিষয়ে আমরা আগাম সতর্কতা সংকেত দিতে পারছি না, তাই সচেতনতা বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যসূচিতে বজ্রপাতের সময় করণীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বজ্রপাত বিষয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিয়ে আঞ্চলিক কেন্দ্র গড়ে তোলা জরুরি। জেলা পর্যায়ে বজ্রপাতে আহত ও নিহতদের সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে হবে। বজ্রপাত কমিয়ে আনতে বড় বড় গাছ বিশেষ করে তালগাছ লাগাতে হবে। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী প্রতিটি ভবনে বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করতে হবে। জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল মতিন বলেন, বজ্রপাতে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা এখন বিশ্বে শীর্ষে। শহরে বড় বড় বিল্ডিং থাকায় মৃত্যু কম, গ্রামাঞ্চলে বেশি। সচেতনতার অভাবে মাঠে কাজ করার সময়ে সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে বেশি। আগে তালগাছে বজ্রপাত হতো। এখন তালগাছ ও উঁচু গাছ নেই। গাছপালা কাটায় বজ্রপাত বাড়ছে। বজ্রপাত একটি পরিবেশগত সমস্যা। বজ্রপাত নিরোধে সরকারের পরিকল্পনা থাকা উচিত বলে তিনি মনে করেন। 

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ