• মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৬ ১৪৩১

  • || ১২ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

৭ই মার্চের ভাষণ ও বিএনপির ‘রাজনৈতিক কৌশল’

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৭ মার্চ ২০১৯  

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চকে বাদ দিয়ে বাঙালির ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। দেশের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য, মতবিরোধ এমনকি সংঘাতময় সম্পর্ক থাকার পরও ৭ই মার্চ ইস্যুতে কোনো বিভেদ বা মতানৈক্য থাকার সুযোগ নেই। কারণ ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বিএনপির জন্ম হয়নি।

এই দলটির জন্ম পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পরে। কিন্তু তারপরও ঐতিহাসিক এই দিনটিতে বিএনপির কোনো কর্মসূচি থাকে না। তাতে মনে হতে পারে, তারা বোধ হয় ৭ মার্চকে স্বীকার করে না বা এই দিনটিকে তারা সচেতনভাবে এড়িয়ে যেতে চায়। এটা প্রথমত তাদের হীনম্মন্যতা, দ্বিতীয়ত ভয়। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটু ইতিহাসের পৃষ্ঠায় চোখ বুলানো যাক।

 বিএনপি যদি শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭১, ৭ই মার্চ ইত্যাদি ইস্যুতে একটা যুক্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকতো, তাহলে একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে গড়া দল হওয়া সত্ত্বেও সেই দলটিকে যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে সমালোচিত হতে হত না। 

আওয়ামী লীগের প্রয়াত বর্ষীয়ান নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর আবদুর রাজ্জাক ২০০৯ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে (তিনি তখন সম্ভবত জাতীয় সংসদের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি) সংসদ ভবনে তার কার্যালয়ে আমাদের বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সুবিধার্থে তাকে কিছু পয়েন্ট লিখে দেয়া হয়েছিল। তারা এও বলেছিলেন যে, ভাষণের একটা মোটামুটি খসড়া তৈরি করে দেবেন কি না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কিছু বলেননি।

তিনি পয়েন্ট লেখা কাগজটা রাখলেন। কিন্তু রাজ্জাকরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন তিনি মঞ্চে উঠে যা বললেন, তা লিখিত তো ছিলই না, এমনকি তিনি যে ওই কথাগুলো এরকম ধারাবাহিকভাবে বলে যাবেন, সে বিষয়েও তারা কিছুই আঁচ করতে পারেননি। আব্দুর রাজ্জাকের ভাষায়, ‘এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর শক্তি। পুরো সাত কোটি মানুষকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করলেন যে ভাষণের মধ্য দিয়ে, সেই ভাষণের জন্য তিনি একদিন রিহার্সেল দিয়েছেন বলেও আমার জানা নেই।’

আন্দোলনের গতি প্রকৃতি নিয়ে যারা বিচার বিশ্লেষণ করেন, তারা ৭ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে কীভাবে একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গর্ভে একটা বিপ্লবী আন্দোলন বেড়ে ওঠে। কীভাবে একটির নিঃশেষিত হবার মধ্য দিয়ে আরেকটি সামনে এগিয়ে আসে। ‘আন্দোলনের ডক্টরেট’ কেমন নৈপুণ্যের সাথে একটি আন্দোলনকে তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কাজে করে গেছেন (মনিরুল ইসলাম, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র, পৃষ্ঠা ১৬৭) ।

বঙ্গবন্ধু তার ওই ভাষণে ‘এখন থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’—এই কথাটি সরাসরি না বললেও তিনি ঘোষণা করলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ফলে সাত কোটি বাঙালি ঠিকই বুঝে নিয়েছিল বঙ্গবন্ধু আসলে কী বললেন এবং কী বোঝালেন। কারণ স্বাধীন ও সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সেটি হত রাষ্ট্রদ্রোহিতা। ফলে তিনি এমনভাবে ভাষণ দিলেন যা একইসঙ্গে সাত কোটি বাঙালিকে মুক্তিসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করে এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকেও সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, বাংলা ভূখণ্ড আর পাকিস্তানের অংশ হিসেবে থাকছে না।

আবুল মনসুর আহমদ (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, পৃষ্ঠা) লিখছেন, ‘অনেক তখন মনে করতেন, শেখ মুজিব যদি ৭ই মার্চের ঘোড়-দৌড়-ময়দানের পঁচিশ লাখ লোকের সমাবেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া গবর্নর হাউস, রেডিও স্টেশন ও ক্যান্টনমেন্ট দখল করিতে অগ্রসর হইতেন, তবে একরূপ বিনা রক্তপাতে তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করিতে পারিতেন। তাতে পরবর্তীকালে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ও নয় মাসের যুদ্ধ, তাতে ভারতের সাহায্য এসবের কিছুরই দরকার হইত না।

কিন্তু বাস্তবতার দিক হইতে এটা সমীচীন হইত না এই জন্য যে তাতে সভায় সমবেত বিশ লাখ নিরস্ত্র জনতাকে সংগীন উঁচা করা সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর গুলির মুখে ঠেলিয়া দেওয়া হইত। তাতে নিরস্ত্র জনতাকে জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ডের চেয়ে বহুগুণে বিপুল নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের শিকার বানানো হইত। হত্যাকাণ্ডের বাদেও যেসব নেতা বাঁচিয়া যাইতেন, তাদের গ্রেফতার করা হইত। অতএব ৭ই মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা না করিয়া শেখ মুজিব যোগ্য জননেতার কাজই করিয়াছেন, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।’

প্রয়াত সাংবাদিক ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ এবিএম মূসা (সাতই মার্চের যুদ্ধ ঘোষণা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ২৭৩) মনে করে করেন, সমগ্র বক্তব্য একসাথে পরলে এটি স্পষ্ট হবে যে, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ ছিল অস্ত্র নিয়ে লড়াইয়ের আহ্বান। তিনি ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন, আবার যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতেও বলেছেন। এটি পরিষ্কার যুদ্ধের নির্দেশনা। এবং এটি স্পষ্টতই স্বাধীনতার ডাক। কৌশলগত কারণে তার বলার ভঙ্গি ও শব্দচয়ন ছিল সতর্ক।

কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনককে হত্যার পরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নানাভাবে পরিবর্তনের চেষ্টা হয়েছে। বস্তুত ইতিহাস কখনো পরিবর্তন করা যায় না। কিছু বিষয় চেপে রাখা যায়। কিন্তু একটা সময় পরে সত্যটিই উদ্ভাসিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে বিএনপি নামে যে রাজনৈতিক দলের জন্ম, তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে জিয়াউর রহমান প্রথমবার (জিয়াউর রহমানের নির্বাচিত ভাষণ, পৃষ্ঠা১৫, ১৬) নিজের পক্ষে এবং এরপর বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের সময় থেকে। কিন্তু বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস শুরু হয়েছে বস্তুত ১৯৪৮ সাল থেকেই এবং যা সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নিতে থাকে সত্তরের নির্বাচনের পর থেকেই। আর আনুষ্ঠানিক মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তারিখটি নিঃসন্দেহে ৭ই মার্চ।

কিন্তু এই তারিখটি নিয়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি বরাবরই হয় চুপ অথবা সচেতনভাবে দিনটি এড়িয়ে যেতে চায়। এর একটি কারণ হতে পারে এই যে, সাতই মার্চের প্রসঙ্গ এলে সেখানে বঙ্গবন্ধুর মাহাত্ম্য প্রকাশিত হয়— যা বিএনপি হয়তো নিজেদের জন্য অস্বস্তিকর মনে করে। তারা হয়তো মনে করে যে, সাতই মার্চের প্রসঙ্গ এলে সেখানে আওয়ামী লীগকে বড় করা হয়।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, কিছু বিষয়ে প্রতিপক্ষকে বড় করলে বরং নিজেরই যে কৌশলগত লাভ, সেটি বোধ হয় বিএনপির ভাবনায় নেই। বরং সেই কৌশলগত লাভের কথা চিন্তা করলে খালেদা জিয়ার জন্মদিন প্রকৃত অর্থেই ১৫ আগস্ট হলেও তিনি জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এই দিনে কেক কাটতেন না। কিন্তু বহু বছর ধরে তিনি এই উদারতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন না করলে এবং তিনি যদি এটা ঘোষণা দিতেন যে, যেহেতু এইদিনে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক এবং জাতির পিতাকে খুন করা হয়েছে, তাই এইদিনে আমি জন্মদিনের কেক কাটি না।

এ কথাটি তিনি যদি পলিটিক্যাল স্ট্যান্টবাজি হিসেবেও বলতেন, তাতেও বিএনপির ভোট বাড়তো বৈ কমত না। কিন্তু খালেদা জিয়া বা দল বরাবরই যেমন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে মার খেয়েছে, এই ইস্যুতেও সেই একই অবস্থা। অথচ খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে তারেক রহমানের মৃত্যুর সংবাদে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ছুটে গিয়েছিলেন। তাকে বাড়িতে ঢুকতে না দিয়ে বিএনপি আবারও সেই ভুল রাজনীতির ভিকটিম হয়েছে।

বিএনপির দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমান যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে ছোট করার জন্য নানারকম উদ্ভট তত্ত্বের আবিষ্কার করেছিলেন। কারণ বিএনপি জানে, আওয়ামী লীগের দার্শনিক শক্তির উৎসমূল বঙ্গবন্ধু এবং স্বভাবতই তার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের আবেগ ও সংবেদনশীলতা সবচেয়ে বেশি।

ফলে বিএনপি, বিশেষ করে তারেক রহমান বরাবরই আওয়ামী লীগের এই স্পর্শকাতর জায়গাটিতে আঘাত করতে চেয়েছেন। তাতে যে বস্তুত তারেক রহমান নিজেই নিজেকে হেয় করেছেন বা উদ্ভট কথাবার্তা বলে নিজেকে অনেক সময় হাস্যরসের পাত্রে পরিণত করেছেন।

বিএনপি যদি শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭১, ৭ই মার্চ ইত্যাদি ইস্যুতে একটা যুক্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকতো, তাহলে একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে গড়া দল হওয়া সত্ত্বেও সেই দলটিকে যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে সমালোচিত হতে হত না।

এই দলে যেহেতু অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশপ্রেমিক নেতা আছেন, ফলে দলের সংকটকালে তাদের কিছু বিষয়ে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ এবং জামায়াত ইস্যুতে তাদের এখন ঝেড়ে কাশা তথা খুব পরিষ্কার অবস্থান ঘোষণা করার সময় এসেছে।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ