• সোমবার ২০ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৬ ১৪৩১

  • || ১১ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

ভালোর জন্য ভারসাম্য

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৮ মার্চ ২০১৯  

বিড়াল সাদা না কালো সেটি বড় কথা নয়, বিড়ালটি ইঁদুর ধরে কি না সেটিই বড় কথা। প্রবাদটি মনে পড়লো এ বছরের নারী দিবসের স্লোগান দেখে। এ বছরের নারী দিবসের বিষয়বস্তু হলো ‘ব্যালেন্স ফর বেটার’ বা অধিকতর ভালোর জন্য ভারসাম্য।

 ‘বৈষম্য দূর করতে হবে পরিবার, সমাজ, দেশ ও বিশ্ব থেকে। তাহলে নতুন, উন্নততর, মানবিক মানবসমাজ পেতে পারি আমরা বিশ্ববাসী। কিন্তু প্রশ্ন হলো বিড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে? উত্তরটা নিশ্চয়ই জানেন, তবুও বলি। ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে আমাদের সকলকেই।’ 

ঘুরে ফিরে একই কথা। নারী ও পুরুষের বৈষম্যহীনতা। নারী ও পুরুষের বৈষম্যহীনতা কি মুখের কথায় দূর হওয়ার? বৈষম্য নির্মূল করতে হবে একেবারে শিকড় থেকে। বৈষম্য তো শুরু হয় যখন জন্মের পর পরই কন্যাশিশু দেখে বাবা-মা-আত্মীয়-স্বজনের মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে তখন থেকেই।

অনেকে আবার সান্ত্বনার স্বরে বলেন পরের বার ঠিক মেয়ে হবে, কিংবা মেয়ে হলো ঘরের লক্ষ্মী ইত্যাদি। কারণ এখনও পুত্রসন্তান হলো ‘বংশের প্রদীপ’, এখনও সম্পত্তির সিংহভাগের উত্তরাধিকারী ছেলে। সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়ে দুই সন্তানের সমান অধিকার, সমান বণ্টন যতদিন নিশ্চিত করা না যাবে ততোদিন বৈষম্য বহাল থাকবেই।

এরপর আসা যাক লালন পালনের কথায়। ছেলের পাতে মুরগির রান আর মাছের মুড়ো তুলে দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে এখনও কি বের হতে পেরেছি আমরা? শহুরে মধ্যবিত্ত কিছুটা বের হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামীণ সমাজের চিত্রটি কেমন? মীনা আর রাজু এখনও কি সেখানে সমান হতে পেরেছে?

প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ছেলেশিশুর চেয়ে মেয়েশিশুর অংশগ্রহণ বেশি বাংলাদেশে। কিন্তু এর পিছনের কারণ কী? সেটা কি মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে বাবা মা খুব উৎসাহী হয়ে উঠেছেন সেজন্য? মোটেই নয়। স্কুলের খাতায় মেয়ের নাম লিখিয়ে রাখা হয় যেন উপবৃত্তির টাকাটা শিক্ষকদের সঙ্গে ভাগেযোগে নেওয়া চলে।

স্কুলের খাতায় নাম লিখিয়ে মেয়েকে ঘরের কাজে এবং বেশি দরিদ্র হলে গৃহশ্রমিক হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শহরে। ঢাকা শহরে মধ্যবিত্তের বাসাবাড়িতে গৃহশ্রমিকের বৃহত্তর অংশই মেয়েশিশু। তাদের উপর বহুমাত্রিক নির্যাতনের কথা কমবেশি সকলেরই জানা।

আবার নিম্নমধ্যবিত্ত সংসারে মেয়েকে সরকারি স্কুলে আর ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পাঠানোর গল্পও বহু পুরাতন। ছেলের লেখাপড়ার জন্য বাবা-মায়ের যতটা ব্যয়, উৎসাহ, কোচিংয়ে দৌড়াদৌড়ি মেয়ের জন্য খরচ কুলোতে না পারায় ততটা নয়।

উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প আবার আলাদা। এখানে ছেলে ও মেয়ে শিশুর মধ্যে বৈষম্যের চিত্রটা অন্যরকম। ছেলেকে ক্রিকেট টিমে পাঠাতে উৎসাহ দেওয়া হয়। আর মেয়েকে মডেলিংয়ের জন্য তৈরি করা হয়। যতটা রাজ্যের ফ্যাশনেবল পোশাকে মেয়েকে পুতুল সাজিয়ে তাকে মিস ওয়ার্ল্ড হওয়ার জন্য যতটা প্রেরণা দেওয়া হয় ততটা প্রেরণা দেওয়া হয় না মাদাম কুরি বা বেটি ফ্রিডান হতে। টিনএজ মেয়েকে বিউটি পার্লারে নেওয়ার চেয়ে তাকে ক্রীড়া কমপ্লেক্সে আর বিজ্ঞানক্লাবে নেওয়া যে জরুরি সেকথা কে বোঝাবে?

নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের হার এখনও পুরুষের তুলনায় কম। কারণ হলো শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে মাঝপথে তার বিয়ে। অনেক উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারেও দেখা যায় ‘ভালো পাত্র’ পাওয়া গেছে এই জিগির তুলে মেয়ের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে উচ্চশিক্ষার মাঝপথে। ‘ভালো পাত্র’ তারমানে যে ব্যক্তির আয় রোজগার ভালো। স্ত্রীকে সারাজীবন খাওয়াতে পরাতে পারবে। যেন মেয়েটির নিজের অন্নসংস্থানের প্রয়োজন নেই মোটেই।

অথচ ‘ভালো পাত্রী’ পাওয়া গেছে সেই কারণে ছেলের শিক্ষাজীবন অসমাপ্ত রেখে বিয়ে দিতে চাইবেন ক’জন বাবা-মা? এই তথাকথিত ‘ভালো পাত্রের’ জন্য বিয়ের সময় ছেলেপক্ষকে প্রচুর উপঢৌকন দিতেও (ছদ্মবেশী যৌতুক) এক পায়ে খাড়া থাকেন কন্যাপক্ষ। হোক না তা সামর্থ্যের বাইরে, ধারদেনা করে। বোনের বিয়েতে বাবার প্রচুর টাকা খরচ হয়েছে এই অজুহাতে সম্পত্তি বন্টনের বেলায় বোনকে বঞ্চিত করার কুযুক্তিও দেখান অনেক ভাই।

বৈষম্যের বারোমাসী বন্ধ হয় না বিয়ের পর। বরং নতুন দিগন্ত খুলে যায় বৈষম্যের। শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, যৌন, কোন নির্যাতনটা বাদ থাকে নারীর বেলায়? একেক পরিবারে চলে একেক রকম নির্যাতন। কখনও বলা হয় ‘তুমি চাকরি ছাড়ো’, কখনও বলা হয় ‘বেতনের টাকা আমাকে দাও’। কখনও প্রহার, কখনও অবহেলা।

কখনও ‘কাজের লোক নয়, বৌমার রান্না না হলে চলবে না’ আবার কখনও ‘বৌমা রাঁধে ছাঁইপাশ’। উপদেশ আর উপহাসের যাঁতাকলে ঘুরতে থাকে জীবন। এখনও দারিদ্র্য, অপুষ্টি, প্রসবকালীন মৃত্যু, ফিস্টুলা, বার্ধক্যে অবহেলা, অপচিকিৎসা বাঙালি গ্রামীণ নারীর জীবনে সিরিয়াল কাহিনী। এতো গেল পরিবারের ভিতরের কথা। আর ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বাসে-রেলে, পথে ঘাটে ধর্ষণ, ধর্ষণ এবং ধর্ষণ তো নারীর মহানিয়তি।

ফিরে আসি এ বছরের নারী দিবসের বিষয়বস্তুতে। ‘ব্যালেন্স ফর বেটার’। এই অধিকতর ভালোটা কার? পরিবারের, সমাজের, দেশের, বিশ্বের। বৈষম্য দূর করতে হবে পরিবার, সমাজ, দেশ ও বিশ্ব থেকে। তাহলে নতুন, উন্নততর, মানবিক মানবসমাজ পেতে পারি আমরা বিশ্ববাসী। কিন্তু প্রশ্ন হলো বিড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে? উত্তরটা নিশ্চয়ই জানেন, তবুও বলি।

ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে আমাদের সকলকেই। আপনাকে, আমাকে, বিশ্বের প্রতিটি নাগরিককে। ঘন্টাটা বাঁধবো আমরাই, যাতে বৈষম্য নামক দানবের হাত থেকে রক্ষা পাই সকলে।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ